শরীরে হঠাৎ আসা বদল সম্পর্কে মেয়েশিশুকে যেভাবে জানাবেন

প্রখ্যাত সাংবাদিক, লেখক ওরিয়ানা ফাল্লাচির ‘লেটার টু অ্যা চাইল্ড নেভার বর্ন’ উপন্যাসের কথা মনে আছে? সেই উপন্যাসে অনাগত সন্তানের সঙ্গে কথা বলতেন মা। ধরেই নিয়েছিলেন, অনাগত সন্তানটি মেয়ে। সমাজ, সংস্কৃতি, বৈষম্য পৃথিবীর সব বিষয়েই মেয়েকে ধারণা দিতে চেয়েছিলেন এই মা। কথা বলার একটা পর্যায়ে মেয়েকে জানান, একটু বয়স হওয়ার পর থেকে মেয়েরা প্রতি মাসেই একবার রক্ত দেখতে অভ্যস্ত হয়।

আবার ধরুন, তারুণ্যে হয়তো আমরা অনেকেই পড়ে ফেলেছি সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’। যেখানে ১০ বা ১১ বছরের দীপা বাড়ি পালিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কালীপূজার রাতে মণ্ডপে গিয়েছিল। সেখানে দেবীর চোখ আঁকার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকের শব্দের মধ্যে দীপা বুঝতে পারে তাঁর হাঁটু বেয়ে বয়ে যাচ্ছে রক্তের ধারা। ভয় পেয়ে একদৌড়ে বাড়ি চলে যায় দীপা।

আর এরপরই ঠাকুমার শাসনে তাঁর জীবনের অনেকটাই বদলে যায়। বিছানায় না বসা, স্নান না করা, বাইরে না বের হওয়ার কড়া নিয়মের জালে কয়েকটা দিনে যেন দম বন্ধ হয়ে আসে দীপার। সেই বই পড়তে গিয়ে দীপার সঙ্গে অনেকেই মিলিয়েছে নিজেকে। মনে পড়ে গেছে শরীরের হঠাৎ পরিবর্তনে ভয় পেয়ে যাওয়াকে।

সময় এখন অনেকটাই বদলেছে। মা-বাবার সঙ্গে এখন সন্তানের অনেক আলাপই হয়। প্রকৃতির নিয়মও যেন কিছুটা বদলেছে। আগে ১২ বা ১৩ বছরে রক্তপাতের অভিজ্ঞতা হতো। এখন সেটা ৯ বা ১০ বছরই নেমে এসেছে। আপনার শিশুকন্যাটির বয়স কি ৯–এর কোঠায়? তাহলে সময় এসে গেছে। তাকে এবার জানিয়ে দিতে হবে শরীরের এই পরিবর্তনের কথা। জানিয়ে দিতে হবে, যেকোনো দিন হঠাৎ টয়লেটে গিয়ে হয়তো সে দেখতে পাবে রক্তের দাগ। তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

খিদে, পিপাসা, টয়লেটে যাওয়ার মতো এও এক শারীরিক নিয়ম। প্রকৃতির নিয়ম। খিদে পেলে যেমন খাবার খেতে হয়, এই রক্তের দাগ দেখলে মাসের এই কটা দিনও তেমনি প্যাড পরতে হবে। অনেকটা ছোটবেলায় ডায়াপার পরার মতোই।

মাসিক হতে পারে যেকোনো দিন। মায়ের মুখে এমন কথা শোনা ছিল মানহার। মা নাজনীন সুলতানা বলেন, ৭ বা ৮ বছর থেকেই মেয়েকে তিনি এই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। প্রথম মাসিক হওয়ার সময় তাই ভয় পায়নি মানহা। ভেবেছিল এর মানে সে সুস্থ, স্বাভাবিক। সেদিন মায়ের কাছে উপহারও পেয়েছে মানহা।

নাজনীন সুলতানা জানালেন, তিনি নিজে মাসিক নিয়ে একধরনের ভয়ের মধ্যে থাকতেন। মেয়ের মধ্যে যেন সেই ভয় না থাকে, সেভাবেই তাকে আগে থেকে প্রস্তুত করেছেন। পুরো ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই নিতে পেরেছে মেয়ে। শুধু মেয়েকেই নয়, ছেলেকেও বোনের কী হয়েছে, শিখিয়েছেন নাজনীন। পাঁচ বছরের ছেলেকে ওর মতো করে বুঝিয়েছেন। যাতে পরে বড় হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে এ নিয়ে হাসাহাসি করার প্রবণতা না থাকে ওর মধ্যে।

শিশুদের মাসিকের বিষয়ে কখন, কীভাবে জানাতে হবে তার একটি নির্দেশনা দিয়েছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা-ইউনিসেফ। ৮ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে কোনো এক সময় শিশুদের মাসিক হতে পারে। তাই ৮ বছর বয়স থেকেই শিশুকে এ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া যেতে পারে। ধাপে ধাপে দেওয়া যায় এই ধারণা। শিশু যখন তার শরীরের বদল নিয়ে প্রশ্ন করে, ‘আমি কোথা থেকে এলাম’ এ রকম প্রশ্ন করে, উত্তরে সহজভাবে মাসিক সম্পর্কে তাকে জানানো যায়। মাসিক কেন হয়, এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দিতে বলছে ইউনিসেফ। শিশুর মতো করে সহজভাবে তাকে শরীরের প্রক্রিয়া, হরমোন, জরায়ু সম্পর্কে ধারণা দেওয়া যায়।

ইউনিসেফ আরও বলছে, মাসিকের এই আলোচনা শুধু পরিবারে নয়, স্কুলে, বন্ধুদের সঙ্গে হতে পারে। এমনকি ইন্টারনেট থেকেও শেখা যায় এসব বিষয়। বিবিসির এক প্রতিবেদন বলছে, টিকটক থেকেও শিশুরা মাসিক সম্পর্কে জানছে।

তাই গল্পের ছলে, ইন্টারনেট থেকে মেয়েকে জানিয়ে দিতে হবে, একটু বড় হলেই সে এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে। ইউনিসেফ বলছে, মেয়েশিশুদের আরও একটি বিষয় জানানো জরুরি। অপ্রীতিকর অবস্থা এড়াতে সঙ্গে রাখা ব্যাগে সব সময়ই একটি প্যাড রাখতে পারে তাঁরা। পরিবারে বাবা, ভাইদের সঙ্গেও এ নিয়ে মেয়েটি যেন খোলামেলা আলোচনা করতে পারে, সেই পরিবেশ থাকা জরুরি। মেয়ের প্যাড হয়তো তার বাবা বা ভাইটিই কিনে আনতে পারেন।

পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সহজ হলে, সবাই সহানুভূতিশীল হলে, নতুন অভিজ্ঞতার মুখে মেয়েটি ভয়ে কুঁকড়ে যাবে না। বরং বদলে যাওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে। আর এ ক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকা জটিল নয়। ‘পাশে আছি’ সহজভাবে কথাটি বুঝিয়ে দিলেই ডানা মেলে উড়বে আপনার ছোট প্রজাপতি।

Your Ads

Ready to take your business to the next level?

Share it :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Your Ads

Ready to take your business to the next level?